ব্লাড ক্যান্সার হলে রোগী কতদিন বাঁচে?
ব্লাড ক্যান্সার: এটি ক্যান্সারের এমন একটি প্রকার যা রক্তের কোষ এবং হাড়ের মজ্জার মধ্যে বিকৃতির কারণে হয়। সাধারণত তিন ধরনের ব্লাড ক্যান্সার দেখা যায়: লিউকেমিয়া, লিম্ফোমা, এবং মাইলোমা। প্রতিটি প্রকারেরই আলাদা আলাদা চিকিৎসা প্রক্রিয়া এবং রোগের অগ্রগতির হার রয়েছে।
ব্লাড ক্যান্সারের প্রধান কারণ ও লক্ষণ
ব্লাড ক্যান্সারের কারণ
১. জিনগত পরিবর্তন।
২. তেজস্ক্রিয় বিকিরণের সংস্পর্শে আসা।
৩. বংশগতির প্রভাব।
৪. কীটনাশক বা রাসায়নিক পদার্থের সংস্পর্শে আসা।
ব্লাড ক্যান্সারের সাধারণ লক্ষণ
১. অতিরিক্ত ক্লান্তি।
২. ওজন হ্রাস।
৩. হাড় বা জয়েন্টে ব্যথা।
৪. ঘন ঘন সংক্রমণ।
৫. রক্তক্ষরণ বা রক্ত জমাট বাঁধার সমস্যা।
ব্লাড ক্যান্সারের বিভিন্ন ধরণ এবং বাঁচার সম্ভাবনা
লিউকেমিয়া
লিউকেমিয়া হল একটি ধরণ যেখানে শরীরে অস্বাভাবিক শ্বেত রক্তকণিকার সংখ্যা বেড়ে যায়। এর প্রধান দুটি ধরণ হলো:
১. একিউট লিউকেমিয়া: এই ধরনের ক্যান্সার দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। চিকিৎসা দ্রুত শুরু করলে রোগীর বাঁচার সম্ভাবনা বাড়ে।
২. ক্রনিক লিউকেমিয়া: এটি ধীরে ধীরে অগ্রসর হয় এবং দীর্ঘ সময় ধরে চিকিৎসা প্রয়োজন।
লিম্ফোমা
লিম্ফোমা শরীরের লিম্ফাটিক সিস্টেমে আঘাত করে। এর দুটি প্রধান ধরণ হলো:
১. হজকিন লিম্ফোমা।
২. নন-হজকিন লিম্ফোমা।
লিম্ফোমার চিকিৎসা ঠিকভাবে হলে রোগীরা বেশ কয়েক বছর ভালোভাবে বাঁচতে পারে।
মাইলোমা
মাইলোমা হলো প্লাজমা কোষের ক্যান্সার। এই ধরনের ক্যান্সার সাধারণত প্রবীণদের মধ্যে দেখা যায়। চিকিৎসার মাধ্যমে রোগীদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করা সম্ভব।
চিকিৎসা পদ্ধতি এবং বাঁচার সম্ভাবনা
কেমোথেরাপি
কেমোথেরাপি ব্লাড ক্যান্সারের চিকিৎসায় বহুল ব্যবহৃত একটি পদ্ধতি। এটি ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করতে সাহায্য করে।
রেডিয়েশন থেরাপি
এই পদ্ধতিতে তেজস্ক্রিয় রশ্মি ব্যবহার করে ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করা হয়।
স্টেম সেল প্রতিস্থাপন
স্টেম সেল প্রতিস্থাপন ব্লাড ক্যান্সারের একটি কার্যকর চিকিৎসা পদ্ধতি। এটি রোগীর জীবন দীর্ঘায়িত করতে সাহায্য করে।
ইমিউনোথেরাপি
এই পদ্ধতিতে শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতাকে শক্তিশালী করে ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করা হয়।
ব্লাড ক্যান্সারের বাঁচার সম্ভাবনা নির্ধারণে ভূমিকা রাখা বিষয়সমূহ:
১. রোগ ধরা পড়ার সময়।
২. রোগীর বয়স এবং শারীরিক অবস্থা।
৩. চিকিৎসার ধরন এবং প্রতিক্রিয়া।
৪. ক্যান্সারের প্রকার এবং অগ্রগতির স্তর।
ব্লাড ক্যান্সার রোগীর মৃত্যুর লক্ষণ
ব্লাড ক্যান্সারের চূড়ান্ত পর্যায়ে রোগীর শরীরে বিভিন্ন লক্ষণ দেখা দেয়, যা মৃত্যুর সম্ভাবনাকে নির্দেশ করে। এই লক্ষণগুলো চিকিৎসকদের এবং রোগীর পরিবারের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণের সময় একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করে।
ব্লাড ক্যান্সারের মৃত্যুর লক্ষণসমূহ:
১. শারীরিক শক্তি হ্রাস ও অবসাদ
ব্লাড ক্যান্সারের শেষ পর্যায়ে রোগী সাধারণত তীব্র দুর্বলতা এবং ক্লান্তি অনুভব করেন। রোগীর দৈনন্দিন কাজ সম্পাদন করার ক্ষমতা সম্পূর্ণভাবে হারিয়ে যায়।
২. রক্তক্ষরণ ও ফোলা
১. রোগীর শরীরের বিভিন্ন স্থানে সহজেই রক্তক্ষরণ হতে পারে, যেমন নাক, মুখ বা চামড়ার নিচে।
২. শরীরে ফোলাভাব দেখা দিতে পারে, বিশেষ করে হাত, পা, মুখ এবং পেটের চারপাশে।
৩. শ্বাসকষ্ট
শেষ পর্যায়ে রক্তের অক্সিজেন বহন করার ক্ষমতা হ্রাস পায়, যা রোগীর শ্বাসকষ্টের কারণ হতে পারে। অনেক সময় শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া মৃত্যুর নিকটবর্তী একটি ইঙ্গিত হতে পারে।
৪. সংক্রমণ বৃদ্ধি
ব্লাড ক্যান্সারের কারণে রোগীর প্রতিরোধ ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে যায়। ফলে ফুসফুস, ত্বক বা মূত্রনালীতে ঘন ঘন সংক্রমণ দেখা দেয়, যা নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়ে।
৫. তীব্র ব্যথা
১. হাড়, জয়েন্ট বা শরীরের অন্যান্য অংশে তীব্র ব্যথা অনুভূত হয়।
২. কিছু রোগীর ক্ষেত্রে এই ব্যথা এতটাই তীব্র হয় যে ব্যথানাশক ওষুধও অকার্যকর হয়ে পড়ে।
৬. মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা হ্রাস
১. স্মৃতিশক্তি দুর্বল হওয়া।
২. বিভ্রান্তি বা মানসিক অস্পষ্টতা।
৩. অজ্ঞান হয়ে যাওয়া বা কোমায় চলে যাওয়া।
৭. ক্ষুধা এবং পানি পানের ইচ্ছা হারানো
শেষ পর্যায়ে রোগীরা সাধারণত খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দেন। এতে শরীরের শক্তির ঘাটতি বেড়ে যায় এবং শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ধীরে ধীরে কাজ করা বন্ধ করে দেয়।
৮. অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিকল হওয়া
১. কিডনি এবং যকৃতের কার্যক্ষমতা হ্রাস পায়।
২. হার্ট এবং ফুসফুসের কার্যক্রম ধীর হয়ে যায়।
৩. শরীরের রক্তচলাচল ধীরগতিতে হয়ে যায়।
৯. চামড়ার রঙ পরিবর্তন
রক্তের অভাবের কারণে রোগীর চামড়া ফ্যাকাশে বা নীলচে হয়ে যেতে পারে। এছাড়া চামড়া শুষ্ক এবং ঠান্ডা হয়ে ওঠে।
১০. মৃত্যুর ঠিক আগে লক্ষণ
১. রোগী দীর্ঘ সময় নিস্তেজ থাকেন।
২. দেহের তাপমাত্রা হ্রাস পায়।
৩. শ্বাস-প্রশ্বাস খুব ধীরে এবং অনিয়মিত হয়ে যায়।
পরিবারের করণীয়
১. রোগীকে শান্তি এবং আরাম দেওয়ার চেষ্টা করুন।
২. ব্যথা নিয়ন্ত্রণের জন্য চিকিৎসকের নির্দেশ অনুসরণ করুন।
৩. মানসিক সমর্থন দিন এবং পাশে থাকুন।
৪. পেশাদার প্যালিয়েটিভ কেয়ার বা হোম কেয়ারের সাহায্য নিন।
ব্লাড ক্যান্সারের শেষ পর্যায়টি রোগীর জন্য যেমন কষ্টদায়ক, তেমনই পরিবারের জন্য মানসিকভাবে চ্যালেঞ্জিং। তবে, সহানুভূতি এবং যত্ন প্রদানের মাধ্যমে এই সময়কে কিছুটা হলেও সহজ করা সম্ভব।
ব্লাড ক্যান্সার থেকে বাঁচার উপায়
ব্লাড ক্যান্সার একটি জটিল এবং প্রাণঘাতী রোগ। তবে সচেতনতা এবং সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে ব্লাড ক্যান্সার প্রতিরোধ বা এর ঝুঁকি হ্রাস করা সম্ভব। এ রোগ থেকে সুরক্ষিত থাকতে কিছু স্বাস্থ্যকর অভ্যাস এবং জীবনযাত্রার পরিবর্তন অপরিহার্য।
১. তেজস্ক্রিয় বিকিরণ এড়িয়ে চলুন
তেজস্ক্রিয় বিকিরণের সংস্পর্শ ব্লাড ক্যান্সারের প্রধান কারণগুলির একটি।
তেজস্ক্রিয় উপাদানের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলুন।
চিকিৎসার সময় অপ্রয়োজনীয় এক্স-রে এবং সিটি স্ক্যান এড়ানোর পরামর্শ নিন।
২. বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ থেকে দূরে থাকুন
কিছু রাসায়নিক পদার্থ যেমন বেনজিন এবং কীটনাশক ব্লাড ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়।
এই ধরনের রাসায়নিক ব্যবহার করার সময় নিরাপত্তা মান বজায় রাখুন।
কাজের সময় গ্লাভস, মাস্ক এবং অন্যান্য প্রতিরক্ষামূলক সামগ্রী ব্যবহার করুন।
৩. সুষম এবং স্বাস্থ্যকর খাদ্য গ্রহণ
সুস্থ রক্ত গঠনের জন্য পুষ্টিকর খাদ্য গুরুত্বপূর্ণ।
প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় ফল, শাকসবজি, প্রোটিন এবং আঁশযুক্ত খাবার যোগ করুন।
প্রক্রিয়াজাত খাবার এবং অতিরিক্ত চিনি এড়িয়ে চলুন।
৪. ধূমপান এবং অ্যালকোহল বর্জন করুন
ধূমপান এবং অতিরিক্ত অ্যালকোহল গ্রহণ রক্তের কোষের ক্ষতি করে এবং ব্লাড ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়।
ধূমপান সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করুন।
অ্যালকোহল সেবন সীমিত বা একেবারে বাদ দিন।
৫. রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ান
শরীরের ইমিউন সিস্টেম শক্তিশালী হলে ব্লাড ক্যান্সারের ঝুঁকি কমে।
নিয়মিত ব্যায়াম করুন।
পর্যাপ্ত ঘুম নিশ্চিত করুন।
মানসিক চাপ কমানোর জন্য মেডিটেশন এবং যোগব্যায়াম অনুশীলন করুন।
৬. নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করান
ব্লাড ক্যান্সারের প্রাথমিক লক্ষণ শনাক্ত করতে সময়মতো স্বাস্থ্য পরীক্ষা জরুরি।
নিয়মিত হিমোগ্লোবিন এবং রক্তকণিকার সংখ্যা পরীক্ষা করান।
শরীরে কোনো অস্বাভাবিক পরিবর্তন বা লক্ষণ দেখা দিলে অবিলম্বে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
৭. বংশগত ঝুঁকি সম্পর্কে সচেতন থাকুন
যদি পরিবারের কারও ব্লাড ক্যান্সারের ইতিহাস থাকে, তাহলে ঝুঁকি বেশি হতে পারে।
বংশগত ইতিহাস সম্পর্কে চিকিৎসকের সঙ্গে আলোচনা করুন।
প্রয়োজন হলে জিনগত পরীক্ষা করান।
৮. পরিবেশগত দূষণ থেকে সুরক্ষিত থাকুন
দূষিত পরিবেশে থাকার কারণে শরীরে ক্ষতিকর পদার্থ প্রবেশ করতে পারে।
নির্মল এবং পরিচ্ছন্ন পরিবেশে থাকার চেষ্টা করুন।
বায়ুদূষণ এড়ানোর জন্য মাস্ক ব্যবহার করুন।
৯. টিকা গ্রহণ করুন
কিছু নির্দিষ্ট ভাইরাস যেমন এপস্টেইন-বার ভাইরাস এবং এইচআইভি ব্লাড ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
প্রাসঙ্গিক ভাইরাস প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় টিকা গ্রহণ করুন।
১০. চিকিৎসকের পরামর্শ নিন
কোনো সন্দেহজনক লক্ষণ দেখা দিলে বিলম্ব না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ ধরা পড়লে চিকিৎসার সাফল্যের হার অনেক বেশি।
উপসংহার
ব্লাড ক্যান্সার একটি জটিল রোগ হলেও, সময়মতো চিকিৎসা এবং সঠিক যত্নের মাধ্যমে রোগীর জীবনকে দীর্ঘায়িত করা সম্ভব। প্রতিটি রোগীর অবস্থা আলাদা, তাই চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।